দখিনের খবর ডেস্ক ॥ দেশে প্রতিদিন মহামারি করোনাভাইরাসে শনাক্তের নতুন রেকর্ড হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মহামারি তাড়া করে ফিরলেও, সম্প্রতি এ ভাইরাস ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশের ৩১টি জেলায় আবারও ছড়িয়ে পড়েছে করোনা সংক্রমণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের ২ আগস্ট একদিনে সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এরপর গত ৩১ মার্চ পাঁচ হাজার ৩৫৮ জন আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে সেই রেকর্ড ভাঙে। পরদিন ১ এপ্রিল একদিনে সর্বোচ্চ ছয় হাজার ৪৬৯ জনের করোনা শনাক্ত হয় আর গতকাল শুক্রবার শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৮৩০ জন, যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। এদিকে গত বছরের ৩০ জুন একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন করোনায় মারা যান। ১ এপ্রিল করোনায় একদিনে মৃত্যু হয় ৫৯ জনের। আর ২ এপ্রিল (গতকাল শুক্রবার) ভাইরাসটিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ জন। স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণের সাথে জড়িত শীর্ষ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও নার্সসহ সকল শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে কেউই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গত কিছু দিন ধরে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বর্তমান অবস্থাকে ‘জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা’ উল্লেখ করে দেশের শতভাগ মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি (প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া, ঘরের বাইরে গেলেই শতভাগ মানুষের মাস্ক পরিধান করা, ঘন ঘন সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা) মেনে চলার পরামর্শ দিলেও সেদিকে অধিকাংশ মানুষেরই ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ দুই তিন সপ্তাহের জন্য সারাদেশে লকডাউন ঘোষণারও পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার জীবন ও জীবিকার কথা ভেবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। করোনা সংক্রমণ রোধে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সরকার ঘোষিত ১৮ দফা বাস্তবায়নে পাঁচ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। এদিকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় এক দিনের মাথায় নতুন রেকর্ড হয়েছে, শনাক্তের হার ছাড়িয়েছে ২৩ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৬ হাজার ৮৩০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে; মৃত্যু হয়েছে আরও ৫০ জনের। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জনে। আর তাদের মধ্যে মোট ৯ হাজার ১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এক দিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা দেশে মহামারী শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর সোমবার প্রথমবারের মত এক দিনে পাঁচ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর আসে। তার মধ্য দিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়িয়ে যায়। তিন দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছয় হাজারও ছাড়িয়ে যায়। টানা কয়েক দিন ধরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হারও বেড়ে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছে যা গত ৬ অগাস্টের পর সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে গত এক দিনে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ২ হাজার ৪৭৩ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাতে এ পর্যন্ত সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪১১ জন হয়েছে। দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় এর ঠিক ১০ দিন পর, ১৮ মার্চ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনা পরিস্থিতি ক্রমাবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ১৮ নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের বেখেয়ালি চলাফেরা আগামীতে আরও বিপর্যয় নিয়ে আসবে। তিনি বলেন, আমরা যতই হাসপাতালগুলোতে বেড বৃদ্ধি করি এতে কোভিড আক্রান্ত রোগী কমাতে পারবো না। আমাদের আক্রান্তের উৎপত্তিতে আরও সচেতন হতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নবনিয্ক্তু উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য দুর্যোগ’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, করোনার সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে আপনি ও আমি কেউ নিরাপদ নই। তিনি করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার্থে বিএসএমএমইউতে দ্রুততম সময়ে শতাধিক সাধারণ শয্যা ও ১০টি আইসিইউ শয্যার বৃদ্ধি করা হবে বলে জানান। এক বছরে মাসওয়ারি নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মাসওয়ারি নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা যথাক্রমে এক হাজার ৬০২, ৬৩ হাজার ৬৪, ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৬৪, চার লাখ ৫৭ হাজার ৫৩০, চার লাখ ১০ হাজার ৩৪৯, তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৪, তিন লাখ ৯৭ হাজার ৪৫২, তিন লাখ ৮৮ হাজার ৬০৭, চার লাখ ৩৬ হাজার ৪৩৯, চার লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৭, চার লাখ ২৪ হাজার ১২৪, তিন লাখ ৯২ হাজার ৩০৫ ও ছয় লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯ জন। মাসওয়ারি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫১, ৭ হাজার ৬১৬, ৩৯ হাজার ৪৮৬, ৯৮ হাজার ৩৩০, ৯২ হাজার ১৭৮, ৭৫ হাজার ৩৩৫, ৫০ হাজার ৪৮৩, ৪৪ হাজার ২০৫, ৫৭ হাজার ২৪৮, ৪৮ হাজার ৫৭৮, ২১ হাজার ৬২৯, ১১ হাজার ৭৭ জন ও ৬৫ হাজার ৭৯ জন। মাসওয়ারি পরিসংখ্যানে মৃতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫, ১৬৩, ৪৮২, ১১৯৭, ১২৬৪, ১১৭০, ৯৭০, ৬৭২, ৭২১, ৯১৫, ৫৬৮, ২৮১ ও ৬৩৮ জন। এক বছরে করোনায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সূচক: চলতি বছরের গত ২৯ মার্চ দেশে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৬৮৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সর্বনিম্ন নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা ছিল ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল, ৩২০টি। গত ২৯ মার্চ সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ১৯৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অপরদিকে গত বছরের ২১ মার্চ সর্বনিম্ন মাত্র ৩৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর গত বছরের ৩০ মার্চ সর্বনিম্ন একজনের করোনা শনাক্ত হয়। আর সর্বোচ্চ করোনা শনাক্ত হয়েছে শুক্রবার ছয় হাজার ৮৩০ জনের। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় একজনে মৃত্যু হয়। আর সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু হয় গত বছরের ৩০ জুন। বিশ্বে শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ১২ কোটি ৯৬ লাখ পেরিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৮ লাখ ২৯ হাজার। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ৩৪তম স্থানে আছে বাংলাদেশ, আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৪০তম অবস্থানে।
Leave a Reply